সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যে চিত্রটি প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে, তা হলো গভীর এবং বহুস্তরীয় বিভাজন। ছোট-বড় যেকোনো অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা কিংবা গণমাধ্যম – সবখানেই যেন তৈরি হয়েছে এক ‘বিরোধিতার মঞ্চ’, যেখানে একজন বক্তব্য দিলেই অপরজন দাঁড়িয়ে তার বিরোধিতা করছেন। জাতির মৌলিক ও ঐতিহাসিক ইস্যুগুলো নিয়েও এই বিভেদ এখন চরমে।
ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃতি ও রাজনৈতিক দ্বৈরথ
এই বিভেদের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইতিহাসের মূল বিষয়গুলো নিয়ে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান। এক পক্ষ স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দেখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে, অন্য পক্ষ দাবী করে জিয়াউর রহমান-কে। একইভাবে, এক পক্ষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন, আবার অন্য পক্ষ ১৯৭১-এর ভিত্তির উপরেই ২০২৪-এর অভ্যুত্থানকে দেখছেন। এই ধরনের বিতর্ক জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল করছে এবং নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ঐতিহাসিক সত্যের এই রাজনৈতিকীকরণ জাতিকে অযথা আত্মকলহে লিপ্ত রেখেছে।
নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে মতভেদ
দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও নাগরিকেরা বহুধা বিভক্ত। একদিকে দ্রুততম সময়ে একটি জাতীয় নির্বাচনের দাবি উঠছে, অন্যদিকে একটি পক্ষ নির্বাচনকে গৌণ করে আগে সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিচার দাবি করছেন। নির্বাচনকে ঘিরে গণভোটের প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে ভিন্নমত—কেউ নির্বাচন-পূর্ববর্তী গণভোট চান, আবার কেউ নির্বাচনের দিনেই তা আয়োজনের পক্ষে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়েও চরম বিতর্ক বিদ্যমান; এক পক্ষ অংশগ্রহণ সুযোগ দিতে চায়, অন্য পক্ষ তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার পক্ষে। এই জটিল সমীকরণ সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজে আক্রমণাত্মক পরিবেশ
স্যাটেলাইট টেলিভিশনের টক-শোগুলো এখন আর গঠনমূলক আলোচনার প্ল্যাটফর্ম নয়; বরং তা পরিণত হয়েছে আক্রমণাত্মক বাগ্যুদ্ধের ময়দানে। আলোচকরা ব্যক্তিগত আক্রমণে জড়িয়ে যাচ্ছেন এবং মূল ইস্যুগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি, মব তৈরি করে দেশের গুণীজন, জ্যেষ্ঠ নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করার মতো গুরুতর অভিযোগগুলো সমাজকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আলোচক, সাংবাদিক বা লেখকদের কোনো বক্তব্য কারো পক্ষে গেলে তা প্রশংসিত হচ্ছে, কিন্তু বিপক্ষে গেলে তাকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা দিয়ে তীব্র সমালোচনার শিকার হতে হচ্ছে। এই অসহিষ্ণু পরিবেশ মুক্তচিন্তা ও সুস্থ বিতর্কের পথ রুদ্ধ করছে।
উন্নয়ন যখন উপেক্ষিত
যখন উন্নত বিশ্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য নিরন্তর গবেষণা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের নাগরিকেরা অযথা আত্মকলহ, বিভেদ ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত। দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির মূল লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এই ক্রমাগত সংঘাতময় পরিস্থিতি সামগ্রিক জাতীয় অগ্রযাত্রাকে স্তিমিত করছে।
আশা ও নির্বাচনের প্রত্যাশা
এই চরম বিভাজনের মধ্যেও আশার আলো দেখছে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধের কথা জানালেও, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে বিদ্যমান সমস্যার অনেক কিছুরই সমাধান হবে এবং জাতি আত্মকলহ ভুলে উন্নয়নমুখী ধারায় ফিরে যেতে পারবে। এই নির্বাচন তাই কেবল সরকার পরিবর্তনের উপায় নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একমাত্র প্রত্যাশিত পথ।
আ হ জুবেদ
সম্পাদক -অগ্রদৃষ্টি











